মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ও রাসায়নিক বন্ধন নোট
১. পর্যায় সারণির মৌলিক তথ্য ও ব্লকভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস
ক. পর্যায় সারণির ভিত্তি
●পর্যায় সারণিতে সর্বমোট মৌল ১১৮ টি
●মৌলের অবস্থান নির্ণয়ে Magic number (ম্যাজিক সংখ্যা) ব্যবহার করা হয়: 2, 8, 8, 18, 18, 32
●ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে মৌলের অবস্থান (গ্রুপ ও পর্যায়) নির্ণয় করা যায় [7]। পর্যায় হলো n এর সর্বোচ্চ মান
●s-ব্লক গ্রুপের ক্ষেত্রে : সর্বশেষ s এর ইলেকট্রন সংখ্যাই গ্রুপ সংখ্যা
●p-ব্লক গ্রুপের ক্ষেত্রে : p এর ইলেকট্রন সংখ্যা + সর্বশেষ s এর ইলেকট্রন সংখ্যা + 10
●d-ব্লক গ্রুপের ক্ষেত্রে : d এর ইলেকট্রন সংখ্যা + সর্বশেষ s এর ইলেকট্রন সংখ্যা
●s, p, d, f ব্লক মৌলসমূহ: পর্যায় সারণিকে ৪টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে ।
→s ব্লক (14 টি) : সর্বশেষ ইলেকট্রন s-অরবিটালে যায়। গ্রুপ-1, গ্রুপ-2, ও গ্রুপ-18 এর He এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত [5, 9]। সাধারণ ইলেকট্রন বিন্যাস: ns¹–²
→p ব্লক (36 টি) : সর্বশেষ ইলেকট্রন p-অরবিটালে প্রবেশ করে। গ্রুপ (13-18) (He ব্যতীত) এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত [9]। সাধারণ ইলেকট্রন বিন্যাস: ns² np¹–⁶
→d ব্লক (41 টি) : সর্বশেষ ইলেকট্রন d-অরবিটালে প্রবেশ করে। গ্রুপ (3-12) এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত । সাধারণ ইলেকট্রন বিন্যাস: (n-1)d¹–¹⁰ ns¹–² । এদেরকে Transition elements (সন্ধি মৌল) বলা হয়।
→f ব্লক (27 টি) : সর্বশেষ ইলেকট্রন f-অরবিটালে প্রবেশ করে। La ব্যতীত ল্যান্থানাইড সিরিজ এবং Ac, Th ব্যতীত অ্যাকটিনাইড সিরিজ এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত । সাধারণ ইলেকট্রন বিন্যাস: (n-2)f¹–¹⁴ (n-1)d⁰–¹ ns²। f–ব্লক মৌলসমূহ পর্যায় তালিকার 3 নং গ্রুপে অবস্থান করে
খ. কর্ণ সম্পর্ক (Diagonal Relationship)
●পর্যায় সারণির ২য় পর্যায়ের মৌলসমূহের কিছু ধর্ম ৩য় পর্যায়ের তাদের ডানদিকের কোনাকুনিভাবে অবস্থিত মৌলের ধর্মের সাথে অধিকতর মিল দেখায় [12]।
উদাহরণস্বরূপ: Li এর সাথে Mg, Be এর সাথে Al, এবং B এর সাথে Si এর ধর্মের সাদৃশ্য দেখা যায়
২. পর্যায়বৃত্ত ধর্মাবলি (Periodic Properties)
●প্রধান পর্যায়বৃত্ত ধর্মগুলো হলো: আকার-ব্যাসার্ধ, আয়নিকরণ শক্তি, ইলেকট্রন আসক্তি, তড়িৎ ঋণাত্মকতা, ধাতব ও অধাতব ধর্ম[2, 14]।
ক. কার্যকর নিউক্লিয়ার চার্জ (Zeff) ও আচ্ছাদন প্রভাব (Shielding Effect)
●কার্যকর নিউক্লিয়ার চার্জ (Zeff): এটি হলো নিউক্লিয়াসের প্রকৃত চার্জ (Zact) এবং আচ্ছাদন ধ্রুবকের (σ) মধ্যে পার্থক্য: Zeff = Zact – σ
●পর্যায় বরাবর বাম থেকে ডানে গেলে Zeff বৃদ্ধি পায় [16]।
●আচ্ছাদন প্রভাব (Shielding Effect) কার্যকরী নিউক্লিয়ার চার্জকে প্রভাবিত করে
খ. আকার ও ব্যাসার্ধ (Size and Radius)
●পর্যায় বরাবর বাম থেকে ডানে গেলে সাধারণত আকার হ্রাস পায়
●ভ্যান্ডার ওয়ালস ব্যাসার্ধ সবচেয়ে বেশি হয় (যেমন: Ne > H
●ল্যান্থানাইড সংকোচন (Lanthanoid Contraction): f-অরবিটালের দুর্বল আচ্ছাদন প্রভাবের কারণে ৬ষ্ঠ পর্যায়ের d-ব্লক মৌলগুলোর আকার তুলনামূলকভাবে কমে যায় [19, 20]। এর ফলে একই গ্রুপের ৪থ ও ৫ম পর্যায়ের মৌল (যেমন: Zr ও Hf) বা ৫থ ও ৬ষ্ঠ পর্যায়ের মৌল (যেমন: Mo ও W) এর পারমাণবিক ব্যাসার্ধ প্রায় সমান হয় ।
●আয়নিক ব্যাসার্ধ: সম-ইলেকট্রনীয় (Isoelectronic) আয়নের ক্ষেত্রে প্রোটন সংখ্যা যত বেশি, আকার তত ছোট হয় [19]। যেমন, N³⁻ > O²⁻ > F⁻
গ. আয়নিকরণ শক্তি (Ionization Potential, IP)
●গ্যাসীয়, বিচ্ছিন্ন পরমাণু থেকে ১ মোল ইলেকট্রন অপসারণ করতে যে শক্তি প্রয়োজন, তাকে আয়নিকরণ শক্তি বলে [22]। এটি সর্বদা ধনাত্মক (+ve) হয়
●পর্যায় বরাবর বাম থেকে ডানে গেলে সাধারণত IP বৃদ্ধি পায়
●পূর্ণ বা অর্ধপূর্ণ অরবিটালের জন্য IP-তে ব্যতিক্রম দেখা যায়
●পূর্ণ s অরবিটাল (Be, Mg) এর জন্য B, Al এর তুলনায় IP বেশি হয়
●অর্ধপূর্ণ p অরবিটাল (N, P) এর জন্য O, S এর তুলনায় IP বেশি হয়
●সবচেয়ে বেশি আয়নিকরণ বিভব বিশিষ্ট মৌল হলো He এবং সবচেয়ে কম হলো Cs
ঘ. ইলেকট্রন আসক্তি (Electron Affinity, EA)
●গ্যাসীয় পরমাণুতে ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে অ্যানায়ন গঠনে যে শক্তি নির্গত বা শোষিত হয় ।
●প্রথম ইলেকট্রন আসক্তি (EA₁) সাধারণত ঋণাত্মক (-ve) হয় (শক্তি নির্গত হয়) [27]। কিন্তু দ্বিতীয় ইলেকট্রন আসক্তি (EA₂) ধনাত্মক (+ve) হয় (শক্তি শোষিত হয়) ।
●পর্যায় বরাবর সাধারণত EA বৃদ্ধি পায় ।
●ব্যতিক্রম: হ্যালোজেনসমূহের EA ক্রম হলো: Cl > F > Br > I [28, 29]। ফ্লোরিনের ছোট আকারের কারণে ইলেকট্রন ঘনত্ব বেশি হওয়ায়, আগত ইলেকট্রনের প্রতি বিকর্ষণ বেড়ে যায়।
●গ্রুপ 16 এর EA ক্রম: S > Se > Te > Po > O
ঙ. তড়িৎ ঋণাত্মকতা (Electronegativity, EN)
●সমযোজী বন্ধনের ইলেকট্রন যুগলকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা
●পর্যায় বরাবর বাম থেকে ডানে গেলে EN বৃদ্ধি পায়
●EN এর ক্রম: F > Cl > Br > I । ফ্লোরিনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা সবচেয়ে বেশি (4.0)
চ. ধাতব ও অধাতব ধর্ম (Metallic and Non-metallic Character)
●পর্যায় বরাবর বাম থেকে ডানে গেলে অধাতব বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায় এবং ধাতব বৈশিষ্ট্য হ্রাস পায়
●ধাতু ও অধাতুকে পর্যায় সারণিতে একটি এসিঁড়ি লাইন (Zig-zag line) দ্বারা পৃথক করা হয়েছে
●গ্রুপ IIIA, IVA, VA, VIA-তে ধাতু ও অধাতু উভয়ই থাকে ।
৩. মৌলের অক্সাইড ধর্ম (Oxide Properties)
অক্সাইডকে মূলত অম্লীয় (Acidic), ক্ষারীয় (Basic), উভধর্মী (Amphoteric) ও নিরপেক্ষ (Neutral) এই চার ভাগে ভাগ করা যায় ।
প্রকারভেদ →প্রকৃতি →উদাহরণ
●ক্ষারকীয় অক্সাইড→ধাতু ও নিম্ন জারণ মান (+1, +2, +3) →K₂O, Na₂O, MgO, CaO
●অম্লীয় অক্সাইড→অপধাতু/অধাতু ও উচ্চ জারণ মান (+5, +6, +7)→SiO₂,SO₂, CO₂, N₂O₅, CrO₃
●উভধর্মী অক্সাইড→ধাতু/অপধাতু, জারণ মান সাধারণত +3 বা +4→ZnO, SnO, BeO, Al₂O₃, PbO, Ga₂O₃
●নিরপেক্ষ অক্সাইড→কো নো পানীয় নাই→CO, NO,H₂O N₂O
●ধাতুর জারণ মান বৃদ্ধির সাথে সাথে অক্সাইডের অম্লীয় ধর্ম বৃদ্ধি পায় (যেমন: CrO ক্ষারকীয়, Cr₂O₃ উভধর্মী, CrO₃ অম্লীয়)।
●পার-অক্সাইড (BaO₂) ও সুপার অক্সাইড (KO₂) বিশেষ শ্রেণির অক্সাইড ।
৪. s-ব্লক মৌলের বিশেষ রাসায়নিক ধর্ম ও দ্রাব্যতা
ক. s-ব্লক মৌলের রাসায়নিক বিক্রিয়া
●গ্রুপ-1 মৌলসমূহ (M) হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব হাইড্রাইড (MH) এবং অক্সিজেন এর সাথে বিক্রিয়া করে অক্সাইড/পার-অক্সাইড/সুপার অক্সাইড তৈরি করে ।
●Li সাধারণত Li₂O (অক্সাইড) গঠন করে ।
●Na সাধারণত Na₂O₂ (পার-অক্সাইড) গঠন করে ।
●K, Rb, Cs সাধারণত KO₂ (সুপার অক্সাইড) গঠন করে
●Li এবং Mg উভয়েই নাইট্রোজেনের সাথে সরাসরি বিক্রিয়া করে নাইট্রাইড (Li₃N, Mg₃N₂) গঠন করতে পারে ।
খ. দ্রাব্যতা ও তাপীয় স্থিতিশীলতা
●দ্রাব্যতা (Solubility) এবং তাপীয় স্থিতিশীলতা (Thermal Stability) নির্ভর করে ল্যাটিস শক্তি (Lattice energy) এবং হাইড্রেশন শক্তির (Hydration energy) ভারসাম্যের উপর
●ছোট অ্যানায়নযুক্ত যৌগ: (F⁻, OH⁻) এর ক্ষেত্রে, ছোট ক্যাটায়ন (Li⁺, Mg²⁺) এর ল্যাটিস শক্তি বেশি হওয়ায় দ্রাব্যতা হ্রাস পায়
●ক্ষারকীয় ধর্ম/দ্রাব্যতার ক্রম: LiOH < NaOH < KOH এবং Mg(OH)₂ < Ca(OH)₂ < Ba(OH)₂
●পলিঅ্যাটমিক অ্যানায়নযুক্ত যৌগ: (CO₃²⁻, SO₄²⁻): ক্যাটায়নের পোলারায়ন ক্ষমতা স্থিতিশীলতা নির্ধারণ করে ।
●ছোট ক্যাটায়ন (Be²⁺, Li⁺) এর পোলারায়ন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এরা কম তাপীয় স্থিতিশীল হয়।
●তাপীয় স্থিতিশীলতার সঠিক ক্রম: BeCO₃ < MgCO₃ < CaCO₃ < SrCO₃ < BaCO₃
৫. এমসিকিউ ও প্রয়োগমূলক প্রশ্ন (MCQ and Application Tasks):
1. মৌলের অবস্থান নির্ণয়: পারমাণবিক সংখ্যা বা ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে পর্যায় ও গ্রুপ নির্ণয়
2. পর্যায়বৃত্ত ধর্মের ক্রম: IP, EA, আকার, বা তড়িৎ ঋণাত্মকতার সঠিক ক্রম নির্ণয় (ব্যতিক্রমসহ)
3. আয়নিক ব্যাসার্ধের তুলনা: বিশেষত সম-ইলেকট্রনীয় বা ক্যাটায়ন-অ্যানায়নের আকার তুলনা
4. অক্সাইড শ্রেণিবিন্যাস: প্রদত্ত অক্সাইডগুলোর মধ্যে কোনটি অম্লীয়, ক্ষারীয়, বা উভধর্মী তা চিহ্নিত করা
5. রাসায়নিক বন্ধন: ডাইভ্যালেন্ট যৌগের ইলেকট্রন ডট গঠন আঁকা
6. s-ব্লক বৈশিষ্ট্য: দ্রাব্যতা, তাপীয় স্থিতিশীলতা, বা বিজারণ ধর্মের ক্রম নির্ণয়
d-ব্লক মৌল (d-Block Elements)
ক. ইলেকট্রন বিন্যাস ও ব্যতিক্রম
d-ব্লক মৌলগুলোর ইলেকট্রন বিন্যাস ৩d, ৪d, এবং ৫d সিরিজের জন্য সারণী আকারে দেখানো হয়েছে।
৩d সিরিজ: Sc (২১) থেকে Zn (৩০)।
ব্যতিক্রম: Cr (ক্রোমিয়াম) এবং Cu (কপার)-এর ইলেকট্রন বিন্যাসে ব্যতিক্রম দেখা যায়।
Cr: [Ar] 3d⁵ 4s¹ (অর্ধ-পূর্ণ d-অরবিটালের স্থিতিশীলতা)।
Cu: [Ar] 3d¹⁰ 4s¹ (পূর্ণ d-অরবিটালের স্থিতিশীলতা)।
৪d সিরিজ: Nb (Niobium) এবং Pd (Palladium)-এর মতো মৌলগুলোতেও ইলেকট্রন বিন্যাসে বিশেষ ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন: Pd এর ক্ষেত্রে [Kr] 4d¹⁰ 5s⁰।
খ. ভৌত ধর্মের প্রবণতা ও ব্যতিক্রম (গলনাঙ্ক/স্ফুটনাঙ্ক)
গলনাঙ্ক/স্ফুটনাঙ্ক (Boiling Point) মূলত বিজোড় ইলেকট্রন সংখ্যা (∝ স্থায়িত্ব) এবং স্থিতিশীল অবস্থার উপর নির্ভরশীল।
গলনাঙ্ক/স্ফুটনাঙ্কের গ্রাফ: গ্রাফে দেখা যায়, অবস্থান্তর মৌলগুলোর গলনাঙ্ক/স্ফুটনাঙ্কের মান সাধারণত উচ্চ হয় এবং এটি একটি বিশেষ প্রবণতা অনুসরণ করে।
গুরুত্বপূর্ণ ক্রম (MCQ): Cr, Fe, Mn, Zn এর গলনাঙ্কের সঠিক ক্রম হলো: Cr > Fe > Mn > Zn।
৩. অবস্থান্তর মৌল (Transition Elements)
অবস্থান্তর মৌল হলো সেই d-ব্লক মৌলগুলো, যাদের ক্যাটায়ন অবস্থায় আংশিকভাবে পূর্ণ d-অরবিটাল (d¹ থেকে d⁹) থাকে। Scandium (Sc) (Sc³⁺ → 3d⁰) এবং Zinc (Zn) (Zn²⁺ → 3d¹⁰) অবস্থান্তর মৌল নয়, যদিও তারা d-ব্লকের অন্তর্ভুক্ত।
ক. সাধারণ বৈশিষ্ট্য (Characteristics)
অবস্থান্তর মৌলগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. পরিবর্তনশীল জারণ অবস্থা (Variable Oxidation State)।
২. প্রভাবকরূপে ক্রিয়া করে (Acts as Catalyst)।
৩. জটিল আয়ন গঠন করে (Forms Complex Ions)।
৪. রঙিন যৌগ গঠন করে (Forms Colored Compounds)।
৫. চুম্বকত্ব প্রদর্শন করে থাকে (Exhibits Magnetic Properties)।
খ. জারণ অবস্থা
অবস্থান্তর মৌলগুলো একাধিক জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে:
Mn (ম্যাঙ্গানিজ) এর জারণ অবস্থা: +2, +3, +4, +6, +7।
Cu (কপার) এর জারণ অবস্থা: +1, +2।
Fe (আয়রন) এর জারণ অবস্থা: +2, +3।
গ. প্রভাবক (Catalysis)
বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়ায় অবস্থান্তর ধাতুগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে:
Fe: অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ (Haber-Bosch) বিক্রিয়ায় (550°C তাপমাত্রায়)।
Ni: ইথিনকে ইথেনে রূপান্তরে (হাইড্রোজিনেশন) (200°C তাপমাত্রায়)।
Cu: অ্যালকোহলকে অ্যালডিহাইডে রূপান্তরে (300°C তাপমাত্রায়)।
৪. জটিল যৌগ (Complex Compounds)
ক. জটিল যৌগের সংজ্ঞা ও উপাদান
জটিল যৌগ অবস্থান্তর মৌল এবং লিগ্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
লিগ্যান্ড: যারা কেন্দ্রীয় ধাতব পরমাণুকে ইলেকট্রন জোড় দান করে সন্নিবেশ বন্ধন (Coordinate Bond) তৈরি করে।
নিরপেক্ষ (Neutral) লিগ্যান্ড: NH3, H2O, CO (এরা lone pair বহন করে)।
ঋণাত্মক (Negative) লিগ্যান্ড: OH⁻, Cl⁻, CN⁻।
উপাদানসমূহ: একটি জটিল যৌগে কেন্দ্রীয় ধাতু (Central Metal), লিগ্যান্ড (Ligands), সন্নিবেশ সংখ্যা (Co-ordination Number), কাউন্টার আয়ন (Counter Ion) এবং জারণ সংখ্যা (Oxidation Number) থাকে।
উদাহরণ: K4[Fe(CN)6] এ Fe হলো কেন্দ্রীয় ধাতু, CN⁻ হলো লিগ্যান্ড, সন্নিবেশ সংখ্যা 6, কাউন্টার আয়ন K⁺।
কার্যকর পারমাণবিক সংখ্যা (Effective Atomic Number, EAN): কেন্দ্রীয় ধাতুর পারমাণবিক সংখ্যা + লিগ্যান্ডের মোট ইলেকট্রন সংখ্যা।
উদাহরণ: K4[Fe(CN)6] এর EAN হলো 26 + (6 × 2) = 38 (উৎস অনুযায়ী 24 + (2 × 6) = 36 হিসেবে দেখানো হয়েছে)।
উদাহরণ: [Cu(NH3)4]SO4 এর EAN হলো 27 + (2 × 4) = 35।
খ. লিগ্যান্ডের প্রকারভেদ (Types of Ligands)
লিগ্যান্ড তিন প্রকারের হতে পারে:
১. একদন্তী (Monodentate) লিগ্যান্ড: NH3, H2O, CO, OH⁻, Cl⁻, CN⁻ ইত্যাদি। (সন্নিবেশ সংখ্যা 6 × 1 = 6)।
২. দ্বিদন্তী (Bidentate) লিগ্যান্ড: Ethylenediamine (en)। এরা কিলেশন (Chelation) এর মাধ্যমে ৪-রিং তৈরি করে। (সন্নিবেশ সংখ্যা 3 × 2 = 6)।
৩. বহুদন্তী (Polydentate) লিগ্যান্ড: যেমন EDTA (Ethylenediaminetetraacetate)।
গ. জটিল যৌগের নামকরণ (Nomenclature)
জটিল যৌগের নামকরণের সময় লিগ্যান্ডের নাম ও সংখ্যা অনুযায়ী উপপদ (Prefixes: di, tri, tetra) ব্যবহার করা হয়।
ক্যাটায়নিক জটিল যৌগ: প্রথমে সংখ্যাসহ লিগ্যান্ড + ধাতু + জারণ সংখ্যা + অ্যানায়ন।অ্যানায়নিক জটিল যৌগ: প্রথমে ক্যাটায়ন + সংখ্যাসহ লিগ্যান্ড + ধাতু (শেষে 'ate' যুক্ত হবে) + জারণ সংখ্যা।
নিরপেক্ষ জটিল যৌগ: সংখ্যাসহ লিগ্যান্ড + ধাতু।
ঘ. সংকরায়ন, আকৃতি এবং চুম্বকত্ব (VBT)
জটিল যৌগের গঠন, আকৃতি এবং চুম্বকত্ব ব্যাখ্যার জন্য ভ্যালেন্স বন্ড থিওরি (VBT) ব্যবহার করা হয়।
লিগ্যান্ডের প্রভাব:
স্ট্রং লিগ্যান্ড (Strong Ligand): CN⁻, CO, NH3 ইত্যাদি। এরা কেন্দ্রীয় ধাতুর d-অরবিটালে ইলেকট্রন জোড় বাঁধতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ d-অরবিটাল (Inner orbital complex) ব্যবহার করে সংকরায়ন ঘটায়।
উইক লিগ্যান্ড (Weak Ligand): I⁻, Br⁻, Cl⁻, F⁻, H2O, OH⁻ ইত্যাদি। এরা ইলেকট্রন জোড় বাঁধতে পারে না এবং বাইরের d-অরবিটাল (Outer orbital complex) ব্যবহার করে।
ঙ. স্পেকট্রোকেমিক্যাল সিরিজ (Spectrochemical Series)
এই সিরিজ লিগ্যান্ডগুলোর শক্তিমত্তা অনুসারে ক্রমবিন্যাস দেখায়:
I⁻ < Br⁻ < Cl⁻ < F⁻ < OH⁻ < C2O4²⁻ < H2O < EDTA⁴⁻ < NH3 < en < CN⁻ < CO
(Weak লিগ্যান্ড বাম দিকে এবং Strong লিগ্যান্ড ডান দিকে)।
চ. চুম্বকত্ব (Magnetism)
প্যারাম্যাগনেটিক পদার্থ: যাদের বিজোড় ইলেকট্রন থাকে (μ ≠ 0)।
ডায়াম্যাগনেটিক পদার্থ: যাদের সব ইলেকট্রন জোড়বদ্ধ থাকে (μ = 0)।
ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থ: Fe, Co, Ni।
চুম্বক ভ্রামক (μ): μ = √(n(n+2)) B.M. (Bohr Magneton), যেখানে n হলো বিজোড় ইলেকট্রন সংখ্যা।
উদাহরণ: Sc³⁺ (d⁰)-এর বিজোড় ইলেকট্রন সংখ্যা 0, তাই এটি বর্ণহীন (colorless) এবং ডায়াম্যাগনেটিক।
ছ. ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব (Crystal Field Theory, CFT) এবং রঙিন যৌগ গঠন (Color Formation)
CFT একটি ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বা আয়নিক মডেল।
d-অরবিটাল বিভাজন: লিগ্যান্ডের প্রভাবে কেন্দ্রীয় ধাতুর d-অরবিটালগুলোর শক্তি সমান থাকে না (degenerate অবস্থা থেকে non-degenerate অবস্থায় যায়)।
অষ্টতলীয় ক্ষেত্রে 3d অরবিটাল t2g (ত্রয়ীভাবে অবনমিত) এবং eg (দ্বয়ীভাবে অবনমিত) অরবিটালে বিভক্ত হয়।
রঙিন যৌগ সৃষ্টির কারণ: এই শক্তি পার্থক্যকে (ΔE) অতিক্রম করতে ইলেকট্রন দৃশ্যমান আলোকরশ্মির নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে (hν = hc/λ) এবং অবশিষ্ট আলোকরশ্মি নির্গত করে, যা যৌগের পূরক বর্ণ (Complementary color) হিসাবে দৃশ্যমান হয়।
বর্ণহীনতার শর্ত: d⁰ বা d¹⁰ ইলেকট্রন বিন্যাসযুক্ত আয়নগুলি (যেমন Sc³⁺, Zn²⁺) সাধারণত বর্ণহীন হয়, কারণ d–d ট্রানজিশনের সুযোগ থাকে না।
৫. p-ব্লক মৌল (p-Block Elements)
ক. আর্দ্র বিশ্লেষণ (Hydrolysis) ও ব্যতিক্রম
আর্দ্র বিশ্লেষণ হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় পরমাণুর দুটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক: ১. খালি d-অরবিটাল থাকা, এবং ২. Lone Pair থাকা।
উদাহরণ:
AlCl3 এবং SiCl4 আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়, কারণ তাদের খালি 3d অরবিটাল আছে।
CCl4 আর্দ্র বিশ্লেষিত হয় না, কারণ কার্বনের খালি 2d অরবিটাল নেই।
নাইট্রোজেন হ্যালাইড:
NF3 আর্দ্র বিশ্লেষিত হয় না (N এর খালি d-অরবিটাল নেই)।
NCl3 আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়, কারণ N এর উপর Lone Pair থাকলেও, Cl এর খালি 3d অরবিটাল আছে, যা H2O এর সাথে বন্ধন গঠনে সাহায্য করে।
PCl₃ বনাম NCl₃: PCl3 পানির সাথে দ্রুত আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়, কারণ P–Cl বন্ধন N–Cl বন্ধনের চেয়ে দুর্বল এবং P এর তড়িৎ ঋণাত্মকতা N এর চেয়ে কম।
খ. p-ব্লক যৌগের ব্যতিক্রমী গঠন
অক্সিজেন হ্যালাইড: OF2, OF4 গঠিত হলেও OF6 গঠিত হয় না। কারণ অক্সিজেন দ্বিতীয় পর্যায়ের মৌল হওয়ায় এটির অষ্টক প্রসারণের জন্য খালি 2d অরবিটাল নেই।
সালফার হ্যালাইড: SF2, SF4, SF6 গঠিত হয়। কারণ সালফার তৃতীয় পর্যায়ের মৌল হওয়ায় এটি 3d অরবিটাল ব্যবহার করে অষ্টক প্রসারণ ঘটাতে পারে।
ফসফরাস হ্যালাইড: PCl5 গঠিত হলেও PI5 গঠিত হয় না। এর কারণ হল স্টেরিক হিন্ড্রেন্স (Steric hindrance); আইওডিনের আকার অনেক বড় হওয়ায় পাঁচটি আইওডিন পরমাণু ফসফরাসের চারপাশে স্থান সংকুলান করতে পারে না।
গ. নিষ্ক্রিয় গ্যাস যৌগ গঠন
জেনন ফ্লুরাইড: XeF2, XeF4, XeF6 গঠিত হয়।
ব্যাখ্যা: পঞ্চম পর্যায়ের মৌল জেননের আকার বড় হওয়ায় এবং এর 5p অরবিটালে বিজোড় ইলেকট্রন সৃষ্টির জন্য 5d অরবিটাল ব্যবহার করতে পারার কারণে এই যৌগগুলো গঠিত হয়। তাপমাত্রার প্রভাবে জেননের ইলেকট্রন 5p থেকে 5d অরবিটালে স্থানান্তরিত হয়ে +2, +4, +6, +8 জারণ অবস্থা প্রদর্শন করতে পারে।
ঘ. রাসায়নিক বিক্রিয়া (Inorganic Reactions)
অসামঞ্জস্য বিক্রিয়া (Disproportionation Reaction): যেসব বিক্রিয়ায় একটি মৌল একই সাথে জারিত ও বিজারিত হয়। উদাহরণ:
P4 + NaOH + H2O → PH3 + NaH2PO2 (P এর জারণ সংখ্যা 0 থেকে −3 এবং +1 হয়েছে)।অক্সাইড ও অ্যানহাইড্রাইড বিক্রিয়া: SO2, SO3, SeO2, SeO3 এর মতো নন-মেটাল অক্সাইডগুলো জল ও ক্ষারের (KOH) সাথে বিক্রিয়ায় অ্যাসিড ও লবণ তৈরি করে।
অ্যাম্ফোটেরিক অক্সাইডের বিক্রিয়া: Al2O3 ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে NaAlO2 তৈরি করে।
এসিড অ্যানহাইড্রাইড: P2O5 এর সাথে জলের বিক্রিয়ায় মেটাফসফরিক অ্যাসিড (HPO3) এবং পরে অতিরিক্ত জলের সাথে অর্থোফসফরিক অ্যাসিড (H3PO4) তৈরি হয়।
ঙ. বহুরূপতা ও কাঠামো
কার্বনের বহুরূপতা: গ্রাফাইট (sp², বিদ্যুৎ পরিবাহী), হীরা (sp³, বিদ্যুৎ অপরিবাহী), ফুলারিনেস (C₆₀)।
অন্যান্য কাঠামো: P4 (চতুস্তলীয়), S8 (আট সদস্যের রিং), P4O6, P4O10 এর গঠন দেখানো হয়েছে।
Rate This Article
Thanks for reading: মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ও রাসায়নিক বন্ধন নোট, Stay tune to get latest Blogging Tips.
